বলরাম দাশ অনুপম •
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই ট্রেন যাবে পর্যটন শহর কক্সবাজারে। এই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ৫০ কিলোমিটারের বেশি রেললাইন এখন দৃশ্যমান। এরই মধ্যে এই মেগা প্রকল্পের কাজ ৭৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি প্রকল্প কর্মকর্তাদের। বাকি ২৪ শতাংশ কাজ দ্রুত শেষ করে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল শুরু করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হলে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ আরামদায়ক, সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব যোগাযোগব্যবস্থার প্রবর্তন হবে। সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহন করা সম্ভব হবে।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে। এদিকে, আগামী বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করতে চান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এরপর জুলাই কিংবা আগস্টে শুরু করতে চান ট্রেন চলাচল। এমন লক্ষ্য সামনে রেখে চলছে প্রকল্পের কাজ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ১০০ কিলোমিটার রেলপথে স্টেশন থাকছে আটটি। এগুলো হলো সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদর ও উখিয়া। এজন্য সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি বড় সেতু। এ ছাড়া এই রেলপথে নির্মাণ করা হচ্ছে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট ও ১৪৪টি লেভেলক্রসিং। সাতকানিয়ার কেওচিয়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে একটি ফ্লাইওভার, রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং। হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর চলাচলে ৫০ মিটারের একটি ওভারপাস ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ৫০ কিলোমিটারের বেশি এখন দৃশ্যমান। অধিকাংশ ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে। যেগুলো বাকি আছে সেগুলো আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শেষ হবে। অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ আছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। আমরা চেষ্টা করছি ২০২৩ সালের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে। একইসঙ্গে রেলস্টেশনগুলোর নির্মাণকাজও চলমান আছে।’
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কক্সবাজার সদর থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। স্টেশনটিকে সৈকতের ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। স্টেশন ভবনটির আয়তন ১ লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির বিভিন্ন অংশে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান আছে। নির্মাণাধীন আইকনিক ভবন ঘেঁষে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফরম তৈরি হচ্ছে। এর পাশেই রেলওয়ের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আটটি ভবনের কাজ শেষ পর্যায়ে। স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পর্যটকরা লাগেজ স্টেশনের লকারে রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। এই স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারবেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দাবি করেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি, নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে। এরপরও কাজ চলছে। একইভাবে সাগরপথে জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় অন্য দেশ থেকে মালামাল আনতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রেললাইনটির কাজ দ্রুতগতিতে চললেও গলার কাঁটা হিসেবে ধরা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত সেই কালুরঘাট রেলওয়ে সেতুটি। এই সেতু দিয়ে ট্রেন চলতে পারবে কিনা তা নিয়ে অনেকের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘এই অবস্থায় বড় ইঞ্জিনের ট্রেন এই রেল সেতু দিয়ে পার হবে না। ছোট ইঞ্জিন দিয়ে পার করতে হবে। ছোট ইঞ্জিন দিয়েও পার না হলে সেতুর শক্তি বাড়াতে হবে।’
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. এখলাছ উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন চালু হলে অবশ্যই এলাকার কৃষিতে পরিবর্তন আসবে। ট্রেনে কম টাকায় কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ সহজে পরিবহন করা যাবে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।’
এদিকে সম্প্রতি কক্সবাজার সফরকালে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকেদের জানিয়েছেন, আগামী জুনের মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালু হবে। তখন সারা দেশ থেকে ট্রেন সরাসরি কক্সবাজারে যাবে।
তিনি বলেন, একসময় এটি স্বপ্ন ছিল, এখন সেটা বাস্তবায়নের পথে। কক্সবাজারবাসী যেমন অপেক্ষায় আছে, তেমনি সারা দেশের মানুষ ট্রেনে করে পর্যটননগরী কক্সবাজার আসার জন্য অপেক্ষায় আছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী বছরের জুনের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে।
তিনি জানান, কক্সবাজারে চলাচলের জন্য ট্যুরিস্ট কোচের আদলে উন্নত মানের কোচ দ্বারা ট্রেন চালানো হবে। এজন্য নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫৪টি কোচ কেনা হবে। যেগুলোর জানালা সুপ্রশস্ত। মানুষ অনায়াসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-